মঙ্গলবার, ৪ মে, ২০১০

“সিলেটি কিচ্ছা, কাহিনী, পুঁথি, ছিল্লখ, পই, পইদ্য, গান ... খাস সিলটি”

এ অঞ্চলের বিশাল আর ঐতিহ্যময় সমৃদ্ধ লোকজ সাহিত্যকে কিছুটা হলেও সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াটাই হলো মূল উদ্দেশ্য। লিখতে গিয়ে পদে পদে বুঝেছি এ নিয়ে বিস্তর গবেষনার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু, এটাও ঠিক আমাদের প্রথমে যেতে হবে সংগ্রহে, তার পর যাচাই বাছাই করে একটা সংকলন তৈরি করা যেতে পারে, যা নিয়ে হয়তো অনাগত প্রজন্ম গবেষনা করবে। এখনও আমাদের অনেকই স্মৃতি হাতড়ে কিংবা বয়োজেষ্ট্যদের কাছ থেকে জেনে কিছু লিখতে পারবেন, হয়তো আর কিছু দিন পর সেটাও হয়ে যাবে দুষ্কর। তাই এখনই আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে শুরু করতে হবে আমাদের শিকড়ের সন্ধান, সংগ্রহ করতে হবে যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব। কারও একার পক্ষে এটা প্রায় অসম্ভব, তাই ওয়েবসিলেট আপনাদের দিতে চাচ্ছে সেই সুজোগ যেখানে আমরা সমষ্টিগত ভাবে এই মহৎ কাজে এগিয়ে আসতে পারব; চাই সকলের সহযোগীতা।

সিলেটী ভাষা হিসেবে এক সতন্ত্র ভাষা, কেবল মাত্র আরেকটি আঞলিক ভাষা নয় ! ভাষা কিংবা উপভাষা যাই বলিনা কেনো আমাদের রয়েছে ঋতি মতো একটি স্বাধীন বর্ণমালা, যা নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি, কারন এই পৃথিবীর অনেক স্বীকৃত ভাষার ই নিজস্ব বর্ণমালা নেই। যাই হোক নাগরী ভাষায় আমরা কথা বলিনা, এবং অনেক শব্দাবলী আমরা ব্যবহার করি যা নাগরীতে নেই, বস্তুত, নাগরীর ব্যবহার আমরা দেখতে পাই পুঁথি এবং গান রচনায়। সিলেটের সতন্ত্রতা আমরা দেখতে পাই এ আঞ্চলের ভাষায় সাহিত্যে সংস্কৃতিতে, ওয়েবসিলেট আপনাদের সবার সহযোগীতা চায়, আমাদের এই বিপুল ভান্ডারের সাথে সারা পৃথীবির পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য।

গানঃ বাউলের দেশ, সাধকের দেশ বাংলাদেশ, সিলেট অঞ্চলে যেন এই কথাটা আরও অনেক বেশি সত্যি। জারি, সারি, ঘাটু, পল্লী, আধ্যাতিক, জালালী, বাউলা গান আরও কতো ধরনের গান আমরা পাই। কোন রকম গবেষনা ছাড়াই আমরা এসব গান এবং উদাহরন চিহ্নিত করতে পারি। একটু সময় নিয়ে যদি আমরা সবাই চেষ্টা করি আরও বহূ সংখ্যক গান, ভিন্ন ধরনের গান আমরা বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করতে পারব।

সিলেটকে বলা হয় আধ্যাতিক রাজধানি; যুগে যুগে এ অঞ্চলে হয়েছে বহু আউল, বাউল, সাধকের আবির্ভাব। তাদের সঙ্গীতে আমাদের সাহিত্য হয়েছে সমৃদ্ধ। হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম, রাধা রমন, আরকুম শাহ, ক্বারী আমির উদ্দিন এরকম হাজার বাউল, গীতি কবি লিখে গেছেন হাজারও গান।
জারি, সারি, জালালী, কবি গান, ঘাটু গান, পালা গান সহ আরও অনেক ধরনের রচনা আমরা দেখতে পাই। মুসলমান কিংবা সনাতন উভয় ধর্মাম্বলী সাধকেরা স্রষ্টার ভাবে বিলীন হয়ে লিখেছেন ভাবের গান। প্রেমের গান যেমন আছে, তেমনি আছে দেশের গান, আছে জীবনের গান, আছে কিচ্ছা কাহিণী কত যে বৈচিত্রময় আমাদের এই অঙ্গন তা আসলে না শুনলে বুঝা কঠিন।

কিচ্ছা কাহীনিঃ আম্মা, খালাদের কাছে শুনেছি তাদের ছোটবেলায় তারা রাতের পর রাত শুনতেন কিচ্ছা কাহিনী; আমাদের ছোটবেলায়ও যখন প্রযুক্তির এই জোয়ার ততোটা পৌঁছায়নি আমাদের কাছে; দু একটা হলেও কিছু কিচ্ছা কাহিনী শুনেছি, সেসব কিচ্ছায় আবার ফাঁকে ফাঁকে থাকতো গান। শুনেছি উঠান জুড়ে বসত গম্প বলার আসর, নানারকম পিঠের সাথে সাথে চলতো গল্প। রাজা-বাদশা, রাজপুত্র-রাজকন্যা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, দৈত্য-দানব সব বিষয়ই থাকতো সেই সব কাহিনী তে। আমার অবশ্য সেই ভাগ্য হয়নি, এরকম রাত কাটানোর সুজোগ ও হয়, নাগরিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠার কারনে আমরা অনেকেই এই অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত, সেই দিনও আজ আর নেই প্রযুক্তির ছোয়ায় আমরা নাগরিক জীবনে অনেক বেশি অভ্যস্ত। এমনকি গ্রামে গঞ্জেও সেই সব দিন হয়ে গেছে অতীত। কিন্তু সেই কাহিনী কিচ্ছা এখনও হারিয়ে যায় নি। তবে এখনই যদি আমরা সেগুলো সংগ্রহ না করা শুরু করি, তাহলে সেই দিন গুলির মতো সেই গল্পগুলিও হারিয়ে যাবে।

আমদের বয়োজেষ্ঠ্যদের কাছ থেকে আমাদের সেই সব গল্প সংগ্রহ করে নিতে হবে, বাংলায় পারলে বাংলায়, কোন কারন বশত বাংলায় না পারলে ইংরেজী ফন্টে, লিখা থাকলে স্ক্যান করে, অথবা সেল ফোনে কিংবা অন্য কোন ভাবে রেকর্ড করে হলেও সবাই যদি আমরা তা এখানে পোস্ট করে দিতে পারি, তাহলে ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে এক বিশাল সংগ্রহ, বেঁচে থাকবে আমাদের ঐতিহ্য প্রjজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে...

ছিল্লখঃ বাংলায় প্রবাদ প্রবচন, সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় এটাকে ছিল্লখ, কিনবা ডাখর খতা। অনেক সময় বাংলা খনার বচন, প্রবাদ-প্রবচনের সিলেটি রূপ আমরা দেখতে পাই যেমন একেতো নাচুনে বুড়ি, তার উপরে ঢোলের বাড়ি সিলেটি রূপ এখতো নাছইয়া বুড়ি, তার উফরে ডুলর বাড়ি কিন্তু একই সময়েই আমারা দেখি স্মপূর্ণ সতন্ত্র সিলেটি ছিল্লখ যেমন কার হুউগদা খাউ লো বান্দি ঠাকুর ছিন না কিংবা বাফে না গুতে, চুঙ্গা ভরি মুতে অথবা ওলইদর ডগমগ বাখরর ফাঁকি, নাখর খান্দাত নিয়া দেখ তেজপাতা রইছন বাকি ইত্যাদি আরও অনেক অনেক ছিল্লখ... জানা থাকলে লিখুন, পারলে সংগ্রহ করুন, সবাইকে জানান, চলুন সবাই মিলে এগিয়ে যাই।

পঁইঃ (আসলে এটা প এবং ফ এর মাঝখানে একটা উচ্চারন পই ও না আবার ফই ও না)। গ্রামে এখনও অনেক প্রচলিত, বাংলায় আমরা যেটাকে বলি ধাঁধা। প্রশ্নকর্তা পই বলেন আর উত্তরদাতা সেটাকে ভাঙ্গান; আমি নিশ্চিত আপনাদের সবারই দু-একটা পই জানা আছে... এখন শুধু সময় বের করে লিখার পালা। দেরি করবেননা।

পইদ্যঃ সঠিক সিলেটি রূপ আমার জানা নাই, সিলেটিতে গানের পাশাপাশি অনেক পদ্য, কবিতা রচিত হয়েছে। আমি দু-একটা জানি, স্মৃতি হাতড়ে হয়তো পুরুপুরি সঠিক করে লিখতে পারবনা... আমার গুলি তুলে রাখছি পরবর্তি কোন সময়ের জন্য, আপনার জানা কোন সিলেটি কবিতা, কিংবা পদ্য আছে কি ? আজই লিখে ফেলুন না !

পুঁথিঃ নিজে দেখেছি আমার আম্মাকে পুঁথি পড়তে, নিজের পরিচিত শব্দগুলো বইতে বড্ড অপরিচিত ঠেকছিল, জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম সেটা ছিল নাগরী, হালাতুন্নবী আরও দু একটা পুঁথি ছিল বাসায়, কে জেন নিয়ে গেছে ! হয়তো নিজের সংগ্রহে রাখবে বলে; এখন আর সেই বইটা নেই !
সিলেটের পুঁথি বাংলার অন্য অঞ্চলের থেকে একটু ভিন্ন, নাগরী হরফে লিখা এই সব পুঁথি গুলো, বেশ ছন্দময় এবং সুর করে এগুলো পড়তে হয়। কারও কাছে সংগ্রহে থাকলে, দয়া করে আমাদের জানান, ওয়েবসিলেট সেগুলো সংগ্রহ, সরক্ষণ এবং বিতরন করতে আগ্রহী, প্রয়োজন সবার সহজোগীতা। পুঁথিতে থাকতো মহানবীর জীবন কথা, কালাতীত কোন যুদ্ধ-বিগ্রহের বর্ণনা, কিংবা নিখাদ কোন প্রেমের কাহিনী, থাকতো নবী-রাসূল, অলি-আউলিয়া দের জীবন কাহিনী, অলৌকিক ঘটনাবলীর বিবরন। মুগ্ধ হয়ে ঘন্টার প ঘন্টা শোনা যায় সেই সব কাহিনী, রঙ্গিন পর্দার ছবি থেকে সেগুলো কম বৈচিত্রময় নয়...

খাস সিলেটিঃ সিলেটের অনেক অঞ্চলে অনেক রকম শব্দাবলী আছে যা মূল ভাষা যেটায় আমরা সচরাচর কথা বলি তা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ও ভিন্ন। আমরা যারা শহর অঞ্চলে বেড়ে উঠেছি এবং বসবাস করি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছি বাংলায়, এবং নানা অঞ্চলের মানুষের সাথে একই পরিমন্ডলে থেকেছি, স্বভাবতই আমাদের ভাষা অনেকটাই পরিবর্তিত। কিছুটা যেন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে গেছে আমাদের কথ্য ভাষায়, অনেক শব্দের সিলেটি রূপ জানা থাকলেও আমরা এখন তা আর ব্যবহার করিনা। আবার অনেক আদি আঞ্চলিক শব্দের অর্থও আমরা সঠিক জানিনা। আমরা ইংরেজী, শুদ্ধ বাংলা, রূপান্তরিত সিলেটি যে ভাষায়ই কথা বলি না কেন, হারিয়ে যাওয়া শব্দ গুলোও আমাদের ঐতিহ্য সেগুলোকে আমরা অন্তত লিপিবদ্ধ করে রাখতে পারি, এবং তা এখনই...

সিলেটি ভাষার অনেক শব্দই আসলে শুদ্ধ বাংলা ভাষার একটু পরিবর্তিত রূপ, যেগুলো আঞ্চলিক কিংবা কথ্য রূপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু একই সময় আমরা এমন কিছু শব্দাবলী দেখতে পাই যার মূল রূপের সঙ্গে কোন রকম মিল বা সঙ্গতি নাই। যেমন দক্ষিণ এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশের মতো বাংলাদেশেও সাধারন মানুষের কাছে জনপ্রিয় পোশাক লুঙ্গি, সিলেটিতে আমরা সচরাচর সেটাকে বলি লঙ্গি, কিন্তু এর সম্পুর্ণ বিপরিত একটা শব্দ ও আমরা দেখতে পাই যেটা হলো তফন। এরকম আরও অনেক শব্দ আমরা অনেকেই জানি হয়তো এখন আর ব্যবহার করি না, কিন্তু সেগুলি এখনই সংগ্রহ করে লিখে না ফেললে ভবিষ্যতে এই শব্দগুলো আর কেউ জানবেও না ।

আসুন আপনি আমি সবাই মিলে ধীরে ধীরে সংগ্রহ করি আমাদের ঐতিহ্য, তুলে দেই আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে...